,

স্বাধীনতা দিবসকে বিয়ের দিন মনে করেন বিয়ে না করে গর্ভের ছেলেই তার স্মৃতি ! ৪৪ বছরেও স্বীকৃতি পাননি বীরজ্ঞনা আলেয়া বেগম

এম,এ আহমদ আজাদ ॥ অগ্নিঝড়া মার্চ মাস। স্বাধীনতা এমাসে পাক-হানাদার বাহিনী এদেশে আক্রমন শুরু করে। ৩০ লক্ষ শহীদ আর অসংখ্য মা বোনের ইজ্জতের বিনিময় স্বাধীনতার অর্জন হয়। দীর্ঘ ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা তাদের স্বীকৃতি পাননি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকের মাধ্যমে খোঁজ নিতে গিয়ে সুনামগঞ্জের তারামন বিবির মতো একজন বীরজ্ঞনার সন্ধান পাওয়া গেছে নবীগঞ্জের মুকিম পুর গ্রামে। ৪৪ বছরে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেলেও নবীগঞ্জের বীরজ্ঞনা আলেয়া বেগম কোন স্বীকৃতি পাননি। তিনি বঞ্চিত নিঃগৃহিত হয়েছেন সমাজের কাছ থেকে এবং পাননি সরকারী বেসরকারী কোন অনুদান। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হায়েনার ক্যাম্পের স্মৃতি নিয়ে এখনো আতংকে ক্ষেপে উঠেন। পাক-হায়েনারদের পৈশাসিক নির্যাতনে কথা মনে হলে গভীর রাতে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে যায়। সবাই তাকে মুক্তি কন্যা ডাকলেও পিছনে অনেকেই পিস পিস করে অনেক কিছু বলে। এখন বৃদ্ধ বয়সে এই বীরজ্ঞনা স্বীকৃতি পেয়ে মরতে চান। তিনি বলেন জীবিত থেকেও জীবন যৌবন সব হারিয়েছি। নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ইউনিয়নের সাবেক সদরাবাদ গ্রামের বাসিন্ধা শেরপুর খাদ্য গুদামের প্রহরী ম”ত মনির মিয়ার কন্যা আলেয়া বেগম(৬৫)। তিনি বর্তমানে মুকিমপুর গ্রামে নতুন বাড়ি করে সেখানে বসবাস করছেন। তিনি স্বাধীনতার সময়ে আজাদ বখত উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেনীতে পড়তেন। ৭১ সালের মার্চে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হলে তিনি শেরপুর থেকে গ্রামের বাড়ি পিটুয়া সদরাবাদ গ্রামে এসে আত্বগোপন করেন। তখন মাত্র ১৫ বছরের কিশোরী। হঠাৎ একদিন খবর পান তার সৎ মা-বাবা ও ছোট বোন কে পাক-হানাদার বাহিনীর ধরে নিয়ে তার সন্ধানের জন্য ব্যাপক মারপিট করছে।এসময় পাক-হানাদারদের নির্যাতনে তার ছোট বোন সেলি বেগম (৭) ক্যাম্পে মারা যায় (সময়টা ছিল কার্তিক মাসের ১৯তারিখ তার বর্ননা মতে) । ঐদিন সন্ধ্যারাতে তার গ্রামের বাড়িতে পাকহানাদার বাহিনী তার বাবাকে সাথে নিয়ে এস ঘেরাও করে। ঘর তল্লাশী করে তাকে খোঁজে বাহির করে ধরে নিয়ে যায় শেরপুর পাক-সেনা ক্যাম্পে। আর তার মা-বাবাকে ছেড়ে দেয়। সেখানে তাকে একটি ঘরে বন্ধি করে পাক সেনা ক্যাম্পের শতাধিক হায়েনাররা তিনমাস তাকে পৈশাসিক নির্যাতন করে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তাকে হাত-পা বেধে একটি মাটির তৈরী ব্যাংকারে মধ্যে ফেলে গেলে। মুক্তিযোদ্ধা শাহ আবিদ আলী, ফিরোজ মিয়া ও তাজ উদ্দিন উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এসময় আলেয়া তিনমাসের অন্তঃসত্বা ছিলেন। বাড়িতে এসে মা-বাবা কাউকে না পেয়ে প্রতিবেশিদের বাড়ি থেকে দিন কাটান। এক সময় তার কুল ঝুড়ে আসে এক শিশু পুত্র সন্তান। তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখতে সিন্ধান্ত নেন ছেলেটিকে লালন পালন করে বড় করবেন। ছেলের নাম রাখেন মুক্তি রিপন। ২৬ মার্চ দেশ স্বাধীন হলে সবাই ফিরে আসেন। দেখেন কুমারী মাতা আলেয়ার কূলে পুত্র সন্তান। তিনি সব কিছুকে পিছনে ফেলে ঐ শিশু রিপন মিয়াকে বড় করে তুলেন। নূন আনতে পান্তা পূরায় এমন সংসারে মুক্তি রিপন কে ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত লেখা পড়া করান। তিনি দেশের জন্য জীবন যৌবন নষ্ট করলেও কেউ তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। তার ছেলে রিপন বড় হবার পর তাকে বিয়ে করাতে বড় বাধা হয়ে দাড়ায় পিতৃ পরিচয়। তাই তিনি তার ছেলেকে নিজের তালতো বোনের এর মেয়ের সাথে বিয়ে দেন । রিপন বর্তমানে শেরপুর খাদ্যগুদামে চাকুরী করেন। রিপনের দুই ছেলে এক মেয়ে। এব্যাপারে রিপন মিয়া বলেন আমি একজন বীরজ্ঞনা মহিলার সন্তান এটাই আমার গর্ব ও পরিচয়। তিনি বলেন আমার মাকে যদি সরকার দয়া করে স্বীকৃতি দেন সেটাই আমারদের জীবনের সব চেয়ে বড় পাওয়া হবে। তিনি আরো বলেন আমার মা দেশের জন্য তার সোনার জীবনের সকল স্বপ্নসাধ নষ্ট করেছেন। কিš’ এখনো কিছু লোক তার বিরোদ্ধে নানাকূট চাল দিচ্ছে যাতে তিনি স্বীকৃতি না পান। বীরজ্ঞনা আলেয়া বেগম বলেন আমি জীবনে বিয়ে করেনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য। আমাকে সরকারীভাবে একটা স্বীকৃতি দেয়া হয় সেটা হবে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। আর দেশের স্বাধীনতাটাই হচ্ছে বিয়ের বড় সাধ। স্বাধীনতা দিবসকে আমি মনে করি আমার বিয়ের দিন। স্বাধীনতা ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আমি সরকারের কাছ থেকে কোন কিছুই পাইনি। কিš’ আমি দেশের জন্য মা বাবা বোন সবকিছু খুইয়েছি। আমাকে নিয়ে গ্রামের লোকজন অনেক কিছুই বলে আমি এসবে কান দেই না। সামনে সবাই বলে দেশের জন্য আমি বীরজ্ঞনা। এব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা শাহ আবিদ আলী ও ফিরোজ মিয়ার সাথে যোগাযোগ করা তারা হলে বলেন আমরা বীরজ্ঞনা আলেয়া বেগমকে শেরপুর পাক-হানাদার ক্যাম্পের ব্যাংকার থেকে উদ্ধার করেছি। আমরা একজন বীরজ্ঞনা হিসাবে আলেয়া বেগমকে সরকার স্বীকৃতি দিতে দাবি জানাবো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা৭১ এর সদস্য সচিব ও নারী আসনের সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী বলেন আমার কাছে আলেযা বেগমের সরাসরি কথা হয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন ক্যাম্পে বন্ধি ছিলেন এবং তার নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ননা দিয়ে একটি আবেদন করার জন্য বলি তিনি আর আমাদের কাছে আসেননি। আমাদেও কাছে বিস্তারিত জানালে পরবর্তী ব্যবস্তা আমরা নিবো। এব্যাপারে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ লুৎফর রহমান বলেন, আমাদের কাছে এখনো কোন আবেদন আসে নাই। সে সঠিক বীরজ্ঞনা হয়ে থাকলে স্বীকৃতি পাওয়াটা তার ন্যায্য অধিকার হিসাবে মনে করি। তবে আমাদের কে লিখিত দাবি জানালে ব্যবস্তা নিতে সুবিধা হবে। আমি একজন বীরজ্ঞনা কেন এতোদিন যাবৎ বঞ্চিত হলেন সেই বিষয়টি বিস্তারিত লিখিত আকারে জানানোর জন্য। তখন সরকারী ভাবে তদন্ত হবে এবং একটা সিন্ধান্ত আসবে। তবে আমরা সাংবাদিকদের মাধ্যমে এখন জেনেছি যেহেতু তদন্ত করে মুক্তিযুদ্ধা মন্ত্রনালয়ে চিঠি দেব এখানে একজন বীরজ্ঞনার সন্ধান পাওয়া গেছে।


     এই বিভাগের আরো খবর